বাংলাদেশ বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম দেশ। ভৌগোলিক বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়, ভারত ও মিয়ানমারের মাঝখানে। বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেট। পৃথিবীতে ৮ হাজার ভাষা রয়েছে, এর মধ্যে সয়ংসম্পন্ন ভাষা ৩ হাজার। বিশ্বের সয়ংসম্পন্ন ভাষার একটি সিলেটী ভাষা। তার রয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত নিজস্ব বর্ণমালা, যার নাম ( নাগরী লিপি ) বা ( নাগরি ফুল )
সিলেটের মুসলমানরা আরবি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরী লিপির সমন্বয়ে বিশেষ ধরনের একটি ভাষা লিপির প্রচলন করেছিলেন। এটি নাগরী লিপি হিসেবে পরিচিত ছিল। তৎকালীন শ্রীহট্টের মুসলমান সাহিত্যিকরা হিন্দি প্রভাবিত বাংলার পরিবর্তে নাগরী লিপিতে তাদের ধর্মীয় বই পুস্তক ও সাহিত্য চর্চা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ধারণা করা হয়, হজরত শাহজালাল (র.) এর সমসাময়িক মুসলিম ধর্মপ্রচারকরা এই লিপির প্রসার ঘটিয়েছিলেন।
মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন তার ‘শিলহটের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, নাগরীকদের সুবিধার্থে এক সহজ সুন্দর মিশ্র ভাষার প্রচলন করা হইল। দেব নাগরী ও বাঙ্গালা অক্ষরের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া নাগরী অক্ষরের সৃষ্টি হইল। নাগরী অক্ষরগুলি শিখিয়া লইতে মেধাবী লোকদের পক্ষে একটি মাত্র দিনই যথেষ্ট। ফুলের মত সহজ সুন্দর ও আড়ম্বর বিহীন বলিয়া ঐ ভাষার নাম দেওয়া হইল ফুল নাগরী।
‘শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ’ পত্রিকায় (কার্তিক ১৩৪৩) তিনি লিখেছেন, আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেইকালে শ্রীহট্টের ভাষা ছিল সংস্কৃতবহুল বাঙ্গালা। বিদেশাগত মুসলমানগণ উত্তরকালে এদেশের ভাষাকে নিজ ভাষা রূপে গ্রহণ করিলেও প্রথমাবস্থায় তাঁহারা তাহা সাম্যক রূপে বুঝিয়া উঠিতেন না। অপরপক্ষে নবদীক্ষিত মুসলমান ও হিন্দু ভাতৃগণ, শাসক ও প্রতিবেশী বিদেশাগত উর্দ্দু, ফার্সি মিশ্রিত ভাষা বুঝিতে সক্ষম হইতেন না।
দেশের শাসন ও ধর্ম্মপ্রচার কার্য্য চালাইতে গিয়া হিন্দুদের সহিত কথা কহিতে মুসলমান শাসক ও ধর্ম্মপ্রচারক সম্প্রদায়ও বিশেষ অসুবিধা ভোগ করিতেন। আমাদের বিশ্বাস নানা ভাষার সংমিশ্রণে তখনকার শ্রীহট্টের ভাষা এক অপূর্ব আকার ধারণ করিয়াছিল।
অতঃপর শাসকগণের গবেষণায় এতদ্দেশীয় হিন্দুগণের রাজকার্জ ও নবদীক্ষিত মুসলমানদের ধর্ম্মকার্য্য ও রাজকার্য্য পরিচালনের সুবিধার্থে সর্ব্বসাধারণের বোধগম্য করিয়া এক সহজ সরল (গ্রাম্য) ভাষার পরিচালনাহেতু বাঙ্গালা ও দেবনাগরী অক্ষরের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া ‘সিলেট নাগরী’ অক্ষরের সৃষ্টি হয়। সহজ ও সুন্দর বলিয়া জনসাধারণ ইহার অপর এক নাম দিয়াছিলেন সিলেটের ‘ফুল নাগরী’।
ধর্মীয় ভাবকে কেন্দ্র করে এই লিপির জন্ম হলেও, ধর্মীয় সাহিত্য রচিত হওয়ার পাশাপাশি সিলেটি নাগরি স্থান করে নিয়েছিল সিলেটিদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কার্যাকার্যে। এই লিপিতে লেখা হয়েছে চিঠি, হিসাবপত্র, এমনকি সরকারি দলিল-দস্তাবেজের মার্জিনে সাক্ষীরা স্বাক্ষরও করেছেন। তৎকালীন বিভিন্ন প্রসিদ্ধ সাহিত্য হালতুননবী, জঙ্গনামা, মহব্বতনামা, নূর নছিহত, তালিব হুছন ছাড়াও রচিত হয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্র, জাদুবিদ্যার পুস্তক। রচিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবিতা।
সিলেটি আঞ্চলিক শব্দ ও বাক্যভাণ্ডার দিয়ে রচিত লেখনী ছাড়াও অ-সিলেটি, অ-বাংলা রচনাও রচিত হয়েছে সিলেটি নাগরি লিপিতে। তবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী চরিত্র এই লিপির জন্ম থেকে সম্পৃক্ত ছিল বলে কখনও বিদ্যায়তনে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি এই লিপি। তবুও সাধারণ্যের সরল জীবনে ছড়িয়ে যেতে এই লিপির বাধা পেতে হয়নি। এমনকি বাংলা লিপিতে লেখা জানতেন না এমন অনেক স্বল্প শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত ব্যক্তি নাগরি লিপিতে লিখতে জানতেন কিংবা স্বাক্ষর করতে পারতেন।
নাগরী ভাষার গবেষক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আশ্রাফুল করিম নাগরী লিপিমালাকে বিজ্ঞানসম্মত এবং রীতিমতো বিস্ময়কর বলে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, আধুনিককালের ভাষাবিদরা ভাষাকে সহজ করতে যে পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করছেন, প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ বছর আগে নাগরী লিপিতে তা করা হয়েছিল। তিনি আরও জানান, এটা এতোটাই সহজ যে, নারীরা মাত্র আড়াই দিনে শিখতে পারতেন। আর পুরুষদের শিখতে লাগতো মাত্র একদিন।
‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, নাগরী লিপিতে বর্ণমালায় বর্ণসংখ্যা ৩২টি। বর্ণগুলো হচ্ছে- আ ই উ এ ও ক খ গ ঘ চ ছ জ ঝ ট ঠ ড ঢ ত থ দ ধ ন প ফ ব ভ ম র ল ড় শ হ।
নাগরী ভাষার আরেক গবেষক ড. মোহাম্মদ সাদিক তার ‘সিলেটের নাগরী: ফকিরি ধারার ফসল’ গ্রন্থে ৩৩টি বর্ণের কথা বলেছেন।
সিলেটের নাগরী লিপিতে মোট বর্ণ সংখ্যা ছিল ৩৩টি। এর মধ্যে স্বরবর্ণ ৫টি, ব্যঞ্জনবর্ণ ২৭টি এবং ধ্বনি-নির্দেশক চিহ্ন ১টি। স্বরবর্ণ ৫টি হচ্ছে- আ, ই, উ, এ, ও।
ব্যঞ্জনবর্ণ ২৭টি হচ্ছে- ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, র, ল, শ, হ, ড় এবং একমাত্র ধ্বনি-নির্দেশক চিহ্ন হচ্ছে- ং।
এই ৩৩টি অক্ষরের মধ্যে বিভিন্ন ভাষা লিপির প্রভাব রয়েছে বলে ভাষা গবেষকগণ মত প্রকাশ করেছেন। যদিও এই বিন্যাসের মধ্যেও বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়।
তবে সামগ্রিক বিবেচনায় তালিকাটি মোটামুটি নিম্নরূপ-
বাংলা বর্ণমালা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ৮টি অক্ষর। যথা- ই, ঘ, জ, ঠ, ড, ঢ, দ এবং ড়।
সিলেটি নাগরীর নিজস্ব বর্ণ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ৭টি অক্ষর। যথা- আ, ঝ, ধ, র, ল, হ, ং।
আরবির অক্ষরের উচ্চারণের প্রভাব থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ৪টি অক্ষর। যথা- ক, খ, ফ, ও।
দেবনাগরী ও কাইথি বর্ণের সাদৃশ্য থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ১৪টি অক্ষর। যথা- উ, এ, গ, ঘ, চ, ট, ত, থ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম।
তবে এসব অক্ষর লেখার ভঙ্গি আমাদের বর্তমান বাংলা অক্ষর থেকে ভিন্নতর।
২০-০৫-২০২৪ ইং,
মাওলানা আতিকুর রহমান কামালী
দক্ষিণ শাহারপাড়া, নারাইনপুর ( নয়াবাড়ি )।
atiqurkamaly73@gmail.com