দিরাই প্রতিনিধিঃ সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল গ্রামে পাঠাগারটি অবস্থিত। একে ঘিরে নানা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন গ্রামের মানুষ।
মুক্ত চিন্তা বিকাসে অন্বেষা গণগ্রন্থাগার’–এ বই পড়ায় ব্যস্ত একদল তরুণ। সম্প্রতি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল গ্রামে একদল তরুণ উদ্যোগী হয়ে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন পাঠাগার। এতে যুক্ত হয়েছেন শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষ। গ্রামের স্কুল ও কলেজপড়ুয়াদের এখন সময় কাটে পাঠাগারে বই পড়ে, সাহিত্যের আড্ডায়। এক সময় ঘুরে ঘুরে বই সংগ্রহ করতে হয়েছে তাঁদের।বর্তমানে ভাড়া করা ঘরে কার্যক্রম চলছে।
দিরাই উপজেলার জগদল গ্রামে এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নাম ‘মুক্ত চিন্তা বিকাসে-“অন্বেষা” গণগ্রন্থাগার’। এই পাঠাগার ঘিরে গ্রামের শিক্ষা, সামাজিকতায় পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন মানুষজন।
জগদল গ্রামটি চ্যাপ্টির হাওর ও হেরাচাপ্টি নদীর তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত। বেশ বড়সড় গ্রাম। গ্রামজুড়ে প্রচুর গাছগাছালি। শান্ত, নিরিবিলি গ্রাম।
এই গ্রামে আছে একটি মহাবিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়,একটি জামেয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা,একটি মহিলা মাদ্রাসা ও বাজার। এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ইউরোপ,আমেরিকায় বসবাসকারী। যারা দেশে আছেন তারা ব্যবসা ও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত।
এই গ্রামের কয়েকজন তরুন দেখলেন স্কুল ও কলেজপড়ুয়া তরুণেরা ঘোরঘুরি আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়েই ব্যস্ত। অবসরে কী করা যায়, এ নিয়ে ভাবেন কয়েক তরুণ। সেই ভাবনা থেকেই পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। এরপর গ্রামের সমবয়সী কয়েকজনকে নিয়ে গ্রামের মাঠে বৈঠকে বসেন তাঁরা। তরুণদের এই উদ্যোগে সবাই সম্মতি দেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে বাজারে একটি ঘর ভাড়া নেওয়া হয়। কয়েকজন প্রবাসী চাঁদা দিয়ে কিছু আসবাব কেনে দেন। তরুণেরা নেমে পড়েন বই সংগ্রহে। ‘জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক আগামী প্রজন্ম’ স্লোগানে ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠাগার খুলে দেওয়া হয়।
অন্বেষা পাঠাগারের অন্যতম সদস্য দলিল লেখক জাহেদ আহমেদ হেলন বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্মরা যখন অনেকটা বেকার। তখন অনেকেই ঘোরঘুরি আর ফেইসবুক নিয়ে ব্যস্ত। একদিন কয়েকজন মিলে কী করা যায়, এ নিয়ে আলোচনা করার পরই পাঠাগারে চিন্তাটা মাথায় আসে। পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে এলাকার সবাই উৎসাহ দেন। এই কয়েক মাসে গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। অনেকেই পাঠাগারে এসে বই পড়ে। আমাদের চিন্তা হচ্ছে, পাঠাগারে স্কুল ও কলেজের পাঠ্যসূচির বই রাখা। যাতে এলাকার অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা এখন থেকে বই নিয়ে পড়তে পারে।’
পাঠাগারে নানা বয়সী মানুষ বই পড়েন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন স্কুলের শিক্ষার্থীরাও। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে বই পড়েন। একপাশে একটি আলমিরাতে বই রাখা। বইয়ের তাকে আলাদা করে লিখে রাখা হয়েছে পরিচিতি। প্রবন্ধ, সাহিত্য, কবিতা, বিজ্ঞান, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, কিশোর সাহিত্য, উপন্যাস, রাজনীতি, ইতিহাস, খেলাধুলা, শিশুদের গল্প ও ধর্মীয় বই রয়েছে পাঠাগারে।
পাঠাগার পরিচালনা কমিটির সদস্য কবির আহমেদ বলেন বলেন, পাঠাগারে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৪০০টি বই আছে। শুরুতে পাঠাগার বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকত। এখন দিনের বেশির ভাগ সময়ই খোলা থাকে। প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ জন পাঠক আসেন। এখানে মাসিক সাহিত্য সভা, কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন হয়। এতে গ্রামের লোকজন অংশ নেন। পাঠাগারে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন সদস্যরা।
পাঠাগারে কথা হয় গ্রামের কলেজের ছাত্র তুহিনের সঙ্গে। সে এখন পাঠাগারে নিয়মিত আসে। কবিতা ও গল্পের বই তার পছন্দ। তুহিন বলে, কলেজের সময়ের পর পাঠাগারে আসি। বই পড়ি।
জগদল গ্রামের গ্রামের বাসিন্দা মাষ্টার আব্দুল সোবহান। তিনি জানান, পাঠাগারের শুরু থেকেই তিনি এটির সঙ্গে যুক্ত। পাঠাগারে গ্রামের তরুণদের বই পড়ায় উৎসাহ বাড়ছে। সব বয়সী লোকজন পাঠাগারে আসেন।
তিনি আরও বলেন বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু ছাপা কাগজের বইয়ের ঘ্রাণ, তার মূল্য আলাদা। আলোকিত মানুষ হতে হলে বই পড়তে হবে। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে আমরা এর অভাব বোধ করি। এই পাঠাগার আমাদের নতুন প্রজন্মকে আলো দেবে, আলোকিত করবে। এই চিন্তা থেকে এটিকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি আমরা।’
জগদল গ্রামের তরুণদের এই উদ্যোগে খুশি এলাকার মরুব্বিরাও।
গ্রামের বাসিন্দা পাঠাগার পরিচালনা কমিটির সদস্য ও সমাজকর্মী আফজাল হোসেন, জানান- অন্বেষা বহুমাত্রিক লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। বই পড়া, সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ, মেধার লালন ও প্রসার ঘটানো, কৃষির আধুনিকায়ন, পরিবেশ রক্ষাসহ বিবিধভাবে “অন্বেষা” ভূমিকা রাখতে চায়। অন্বেষা’ র শুভাকাঙ্ক্ষী ও সচেতন মহলের কাছে আমরা আহবান জানাই- একটা সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে আপনারাও আমাদের সাথে সামিল হোন।
গ্রামের তরুণদের উৎসাহ দেখে মুগ্ধ। এটি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতা বিকাশে ভূমিকা রাখতে এবং গ্রামের শিক্ষাসহ নানা উন্নয়নের কেন্দ্রে পরিণত হবে—এটাই আমাদের স্বপ্ন।’