চিকিৎসক’ শব্দের অর্থ- যিনি চিকিৎসা করেন, অর্থাৎ যিনি রোগের নিরাময়, রোগ নির্ণয়, পূর্বাভাস এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও পুনরুদ্ধার করেন। চিকিৎসক সমার্থক শব্দ ডাক্তার, হাকিম, বৈদ্য, ভিষক ও কবিরাজ। “চিকিৎসক” শব্দের ইংরেজি হলো physician, medical practitioner, medical doctor বা শুধু doctor। এই শব্দগুলো স্বাস্থ্য পেশাদারদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
অর্থগত ও সমার্থকগত ভাবে ডাক্তার, দাকতুর, মেডিকাস’ (Medicus) বা ‘ইয়াট্রোস’ (Iatros), হাকিম, কবিরাজ, বৈদ্য ও ভিষক এর মাধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তাছাড়া কর্মগতভাবেও হাকিম, কবিরাজ, বৈদ্য, ডাক্তুর ও ভিষক পেশাদার ব্যক্তিরা চিকিৎসাশাস্ত্রের অনুশীলন করেন এবং মানুষের রোগ, আঘাত বা শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার নিরাময় ও স্বাস্থ্য রক্ষায় কাজ করেন।
তাছাড়াও চিকিৎসক সমার্থক শব্দের মাধ্যে বৈদ্য, ভিষক, চিকিৎসক শব্দ দ্বারা স্বাস্থ্য পেশাদারদের কথা বলা হয়। কিন্তু ডাক্তার শব্দটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বুঝা যায়। ডাক্তার শব্দের উৎপত্তি ও ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করলে দেখা যায়, Doctor ল্যাটিন শব্দ “docēre” থেকে “doctor” শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ “শিক্ষাদান করা” বা “শিক্ষক”। ১৩শ শতাব্দীতে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা শিক্ষা দিতেন, তাদের এই উপাধিতে ভূষিত করা হতো, যাদেরকে “ডক্টরেট” বা “ডক্টরস” বলা হত। এছাড়া প্রাথমিক খ্রিস্টান গির্জায় যারা ধর্মতত্ত্ব ও বাইবেল ব্যাখ্যা করতেন, তাদেরকেও “ডক্টর” বলা হত। সময়ের সাথে সাথে “ডাক্তার” উপাধিটি শুধুমাত্র শিক্ষাবিদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রিধারী ও অনুশীলনের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত পেশাদারদের জন্যও ব্যবহৃত হতে থাকে। কিছু সম্মানীয় পেশায় (যেমন, ডক্টর অফ ফিলোসফি) “ডক্টর” শব্দটি একাডেমিক সম্মান বা উপাধি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, যেখানে এর অর্থ সরাসরি চিকিৎসকের পেশার সাথে যুক্ত নয়। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাকে “ডক্টর” বলা হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে, যখন বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছিল , তখন থেকে এটি ইউরোপে একটি একাডেমিক উপাধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর , এই ব্যবহার বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। “ডক্টর” বা “ডক্টর” সংকুচিত করে, এটি এমন একজন ব্যক্তির জন্য একটি উপাধি হিসাবে ব্যবহৃত হয় যিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। অতীতে, এই শব্দটি যেকোনো শিক্ষিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলেও
বর্তমানে ‘ডাক্তার’ (Doctor) শব্দটির দুটি প্রধান অর্থে ব্যবহ্নত হয়। প্রথমত- এটি একজন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারকে বোঝায়, যিনি রোগের চিকিৎসা করেন। দ্বিতীয়ত, এটি একটি অ্যাকাডেমিক উপাধি, যা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেছেন এমন ব্যক্তিকে বোঝায়, যেমন পিএইচডি (PhD) ডিগ্রিধারীকে বোঝানো হয়। তবে ঐতিহাসিকভাবে, এই শব্দটি ডক্টরেট ডিগ্রিধারীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হত, যেমন দেবত্ব, আইন বা ওষুধের ক্ষেত্রে ডিগ্রিধারীরা।
চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িতদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে অবহিত করা হয়। প্রাচীনকালে চিকিৎসক বা চিকিৎসা প্রদানকারীদের ‘মেডিকাস’ (Medicus) বা ‘ইয়াট্রোস’ (Iatros) নামে ডাকা হতো, যেখানে ‘মেডিকাস’ ছিল গ্রিক ও রোমান শব্দ আর ‘ইয়াট্রোস’ ছিল প্রাচীন গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ‘নিরাময়ক’ বা ‘চিকিৎসক’। প্রাচীনকালে চিকিৎসা সেবা দানকারী বা সর্বজ্ঞদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ তাদেরকে মৈথালী ভাষায় কবিরাজ বা মহাপন্ডিত বলা হতো। এবং মধ্যযুগে চিকিৎসা পদ্ধতি’র চিকিৎসকদের হেকিম। এবং সংস্কৃত ভাষায় চিকিৎসকদের বৈদ্য বা ভিষক বলা হতো। ঠিক তদ্রূপভাবে আধুনিক ভাষায় ডাক্তার বলা হয়।
চিকিৎসকের আরবি প্রতিশব্দ হল طَبِيب (তাবীব)।এটি একটি সাধারণ শব্দ যা ডাক্তার বা চিকিৎসককে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণ কোন চিকিৎসককে যেমন হাকীমুত তিব্ব বলা যায়না। কারণ হাকীমুত তিব্ব হতে হলে কয়েকটি বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। হাকীম শব্দটি কিন্তু সেকেলে নয় আর ডাক্তার শব্দটি মর্ডানও নয়। উভয়টি ভিন্ন অর্থবোধক দুটি পরিভাষা। আরবী তবীব শব্দের সঠিক বাংলা হচ্ছে চিকিৎসক আর বাংলা ভাষীরা চিকিৎসককে দাকতুর (ডাক্তার) বলে সম্বোধন করে থাকেন। আর আরবী ভাষীরা আজও বিজ্ঞানীকে হাকীম বলে সম্বোধন করেন।
বাংলাদেশ ইউনানী মেডিকেল এসোসিয়েশন অনুবাদ করা হয়েছে আঞ্জুমানে আতিব্বা বাংলাদেশ থেকে। এখানেও একটি বিষয় লক্ষনীয় যে এ সংগঠনটি জন্মলগ্নে আঞ্জুমানে হুকামা না বলে আঞ্জুমানে আতিব্বা বলা হচ্ছে। আরবী ভাষায় তবীব এবং দাকতুর শব্দ দুটি সমার্থক হলেও স্থানকাল ভেদে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমনি বাংলা ভাষায় চিকিৎসক এবং ডাক্তার স্থান কালভেদে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কালের বিবর্তনে ভাষা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন আসে।
যেমন, কাজি’ (قاضي) একটি আরবি শব্দ যা قضى অর্থাৎ “বিচার করা” ক্রিয়া থেকে এসেছে। প্রথম দিকে এটি একটি আরবি উপাধি ছিল, যা ইসলামী বিচারকদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। মধ্যযুগীয় বাংলায় মুসলিম শাসনের সময়কালে ‘কাজি’ শব্দটি বাংলায় প্রবেশ করে। এই সময়কালে, কাজী এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি ধর্মীয় ও ফৌজদারি মামলাগুলোর বিচার করতেন এবং কিছু বিচারবহির্ভূত কাজও (যেমন অভিভাবকত্ব ও এতিমদের তত্ত্বাবধান) করতেন। সময়ের সাথে ‘কাজি’ শব্দের আরবি ও ইসলামী পরিমণ্ডল থেকে বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দ ‘বিচারক’ তৈরি হয়, যা একটি সাধারণ ও আধুনিক পরিভাষা। ‘বিচারক’ শব্দটি শুধু আইন বা ধর্মীয় প্রেক্ষাপটেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যে কোনো আদালত বা বিচারিক কার্যক্রমে নিযুক্ত কর্মকর্তাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
ঠিক তেমনিভাবে- এ উপমহাদেশে মোঘল আমলে উচ্চ শিক্ষিত জ্ঞানীদের ‘মোল্লা’ শব্দ দিয়ে সম্বোধন করা হতো। পরবর্তীতে ইংরেজদের আমলে তার পরিবর্তন করে মৌলভী করা হয়। কালক্রমে তা শুধু মাদ্রাসা শিক্ষিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আলীম উলামাকে মাওলানা ও আল্লামা শব্দ দিয়ে সম্বোধন করা হতে থাকে। সে যুগের সর্বোচ্চ সম্মানী খেতাব ‘মোল্লা’ শব্দটি আমাদের দেশে আজ কিন্তু অবহেলিত। বর্তমান সমাজে যারা ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ দিয়ে চিকিৎসা করে তাদেরকে ‘মোল্লা’ শব্দ দিয়ে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। প্রকৃত কোন আলেম উলামাগণকে ‘মোল্লা’ শব্দ দিয়ে সম্বোধন করা হয় না। আজ বাংলা ভাষায় যেভাবে নতুন নতুন শব্দ সংযোজন করা হচ্ছে সেভাবে আরবী ভাষায়ও নতুন নতুন শব্দ, তবীবের স্থলে দাক্তুর ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে আমাদের দেশে প্রকৃত ইউনানী চিকিৎসকদেরকে ভুল সম্বোধিত হাকীম শব্দের স্থলে মাতৃভাষা দাকতুর বা ডাক্তার লিখে সম্বোধন করা যুগোপযোগী ও সমুচিত হবে।
ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রের ডিপ্লোমাধারী ডিইউএমএস, ডিএএমএস ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকগণ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক প্র্যাকটিশনার্স অর্ডিন্যান্স আইন অনুযায়ী তবীব বা হাকীম ও র্বেদ বা কবিরাজ উপাধি ব্যবহার করে থাকেন। আরবি ‘তবীব’ শব্দের বাংলা অর্থ ‘চিকিৎসক’ যিনি ইউনানী চিকিৎসা শাস্ত্রের পন্ডিত। একই ভাবে সংস্কৃত ‘র্বেদ’ শব্দের বাংলা অর্থ ‘চিকিৎসক’ যিনি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রের পন্ডিত। সেইসাথে আরবি হেকিম শব্দের অর্থ যেমন ইউনানী ডাক্তার নির্দেশ করে তেমনি মৈথালী ভাষার কবিরাজ শব্দের অর্থ আয়ুর্বেদিক ডাক্তার নির্দেশ করে।
এজন্য ডাক্তার লিখার আগে ইউ. ডা. অথবা নামের শেষে বিইউএমএস/ ডিইউএমএস বোঝা যাবে যে উনি একজন ইউনানী চিকিৎসক। ডাক্তার শব্দের আগে হোমিও ডা. অথবা নামের শেষে বিএইচএমএস/ ডিএইচএমএস বোঝা যায় যে তিনি একজন হোমিও চিকিৎসক। ডাক্তার শব্দের আগে আয়ূ. ডা. অথবা নামের শেষে ডিএএমএস/ বিএএমএস লিখলে বোঝা যায় যে তিনি একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। ডাক্তার শব্দের আগে ভেটেনারী ডা. অথবা নামের শেষে ডিভিএম লিখলে বুঝা যায় যে তিনি পশু ডাক্তার। ঠিক তেমনি বিপিটি/ বিএসসি-পিটি লিখলে বুঝা যায় যে তিনি ফিজিওথেরাপী চিকিৎসক। মনে রাখতে হবে “চিকিৎসক” শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Doctor। তাই ডাক্তার শব্দটি শুধুমাত্র এমবিবিএস/ বিডিএস’দের মৌরসী সম্পদ নয়।
হামদর্দ দাওয়াখানার নাম পরিবর্তন করে হামদর্দ ল্যাবরেটরীজ করা হয়েছে। কুরছ/ হাব্ব/ শরবতের পরিবর্তন করে যথাক্রমে ট্যাবেলট/ পিল/ সিরাপ যদি লিখা যায়, তাহলে ইউনানী চিকিৎসকদের নামের শুরুতে সঠিক শব্দ ডাক্তার (দাক্তুর) লিখাতে এত আপত্তি কেন?
প্রত্যেক শাস্ত্রের প্রত্যেক ক্যাটাগরির চিকিৎসকদের মনে রাখতে হবে যে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, নাতো আইন দ্বারা বলবৎকৃত কোনো সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। জোর করে কারো উপর আইন চাপিয়ে দেয়া যায় না। আইনের চোখে সবাই সমান।
তাই আসুন এভাবে একে- অপরকে কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি না করে সকল পেশার লোকদের সম্মান দেই, একসাথে মিলেমিশে কাজ করি। আমার প্রয়োজনে আপনি, আপনার প্রয়োজনে আমি এই স্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে একে অন্যের সহযোগী হই, তবেই এদেশের স্বাস্থ্যখাতে আরো উন্নয়ন ও সুচিকিৎসা সম্ভব।
হাফিজুল ইসলাম লস্কর
ইউনানী চিকিৎসক, ইসলামী স্কলার, কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।